মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ নওগাঁ
নওগাঁ জেলা বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রাজশাহী বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। উপজেলার সংখ্যানুসারে নওগাঁ বাংলাদেশের একটি “এ” শ্রেণীভুক্ত জেলা। নওগাঁ জেলা ভৌগোলিকভাবে বৃহত্তর বরেন্দ্র ভূমির অংশ। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমভাগে বাংলাদেশ-ভারত আন্তর্জাতিক সীমারেখা সংলগ্ন যে ভূখণ্ডটি ১৯৮৪ সালের ১লা মার্চের আগ পর্যন্ত নওগাঁ মহকুমা হিসেবে গণ্য হতো, সেটিই বর্তমান বাংলাদেশের নওগাঁ জেলা।
নওগাঁ ইতিহাস
নওগাঁ শব্দর উৎপত্তি হয়েছে ‘নও’ (নতুন -ফরাসী শব্দ ) ও‘ গাঁ’ (গ্রাম ) শব্দ দু’টি হতে। এই শব্দ দু’টির অর্থ হলো নতুন গ্রাম। অসংখ্য ছোট ছোট নদীর লীলাক্ষেত্র এ অঞ্চল। আত্রাই নদী তীরবর্তী এলাকায় নদী বন্দর এলাকা ঘিরে নতুন যে গ্রাম গড়ে উঠে, কালক্রমে তা-ই নওগাঁ শহর এবং সর্বশেষ নওগাঁ জেলায় রুপান্তরিত হয়। নওগাঁ শহর ছিল রাজশাহী জেলার অন্তর্গত। কালক্রমে এ এলাকাটি গ্রাম থেকে থানা এবং থানা থেকে মহকুমায় রুপ নেয়।
১৯৮৪ এর ১ মার্চ- এ নওগাঁ মহকুমা ১১টি উপজেলা নিয়ে জেলা হিসেবে ঘোষিত হয়। বাংলাদেশ উত্তর -পশ্চিমভাগ বাংলাদেশ - ভারত আন্তর্জাতিক সীমা রেখা সংলগ্ন যে ভূখন্ডটি ১৯৮৪ খ্রিঃ এর ১ মার্চের পূর্ব পর্যন্ত অবিভক্ত রাজশাহী জেলার অধীন নওগাঁ মহকুমা হিসেবে গণ্য হতো, তাই এখন হয়েছে নওগাঁ জেলা। নওগাঁ প্রাচীন পুণ্ড্রবর্ধন ভূক্ত অঞ্চল ছিল। অন্য দিকে এটি আবার বরেন্দ্র ভূমিরও একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ ।
নওগাঁর অধিবাসীরা ছিল প্রাচীন পুণ্ড্র জাতির বংশধর। নৃতাত্ত্বিকদের মতে, পুন্ড্ররা বিশ্বামিত্রের বংশধর এবং বৈদিক যুগের মানুষ। মহাভারত্র পুণ্ড্রদের অন্ধ ঋষি দীর্ঘতমার ঔরষজাত বলি রাজার বংশধর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার কারো মতে, বাংলার আদিম পাদদর বংশধর রুপে পুন্ড্রদের বলা হয়েছে। এদিক দিয়ে বিচার করলে নওগাঁ যে প্রাচীন জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল ছিল তা সহজেই বলা যায়।নওগাঁ জেলায় আদিকাল হতেই বৈচিত্রে ভরপুর। ছোট ছোট নদী বহুল এ জেলা প্রাচীনকাল হতেই কৃষি কাজের জন্য প্রসিদ্ধ।
কৃষি কাজের জন্য অত্যন্ত উপযোগী এলাকার বিভিন্ন অঞ্চল নিয়ে অসংখ্য জমিদার গোষ্ঠী গড়ে উঠে। এ জমিদার গোষ্ঠীর আশ্রয়েই কৃষি কাজ সহযোগী হিসেবে খ্যাত সাঁওতাল গোষ্ঠীর আগমন ঘটতে শুরু করে এ অঞ্চলে। সাঁওতাল গোষ্ঠীর মতে এ জেলায় বসবাসরত অন্যান্য আদিবাসীদের মধ্যে মাল পাহাড়িয়া, কুর্মি, মহালী ও মুন্ডা বিশেষভাবে খ্যাত। নানা জাতি ও নানা ধর্মের মানুষের সমন্বয়ে গঠিত নওগাঁ জেলা মানব বৈচিত্র্যে ভরপুর। অসংখ্য পুরাতন মসজিদ, মন্দির, গীর্জা ও জমিদার বাড়ি প্রমাণ করে নওগাঁ জেলার সভ্যতার ইতিহাস অনেক পুরাতন।মুক্তিযুদ্ধে নওগাঁ মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি ও প্রতিরোধ
বিজয় মুক্তযুদ্ধ স্মৃতি স্তম্ভ। ৭১ ফুট উঁচু এই স্তম্ভ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিতে নির্মিত।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের পরপরই নওগাঁয় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গড়ে নওগাঁ কে.ডি. সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের কার্যালয় স্থাপিত হয়েছিল। এখানে বসেই সব ধরনের কর্মসূচি নেওয়া হতো। নওগাঁ ছিল ইপিআর ৭নং উইং এর হেড কোয়ার্টার। ১৮ মার্চ পর্যন্ত এর কমান্ডিং অফিসার ছিল পাঞ্জাবি মেজর আকরাম বেগ।
২ জন ক্যাপ্টেনের একজন ছিলেন পাঞ্জাবি নাভেদ আফজাল, অন্যজন বাঙালি ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন। ২৫ মার্চের আগেই মেজর আকরাম বেগের জায়গায় বাঙালি মেজর নজমুল হক নওগাঁয় ইপিআর এর কমান্ডিং অফিসার হিসেবে বদলি হয়ে আসেন। অবশ্য দেশের উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থির দিকে লক্ষ্য রেখে মেজর বেগ তাকে চার্জ বুঝিয়ে দিতে অসম্মত হন।
ফলে মেজর নজমুল হক মনে মনে ক্ষুব্ধ হয়ে আওয়ামী লীগের তরুণ নেতা আব্দুল জলিলের সাথে পরামর্শ করেন এবং পরামর্শক্রমে বাঙালি ইপিআরদের সহায়তায় ২৪ মার্চ মেজর আকরাম বেগ ও ক্যাপ্টেন নাভেদ আফজালকে গ্রেফতার করেন। পাশাপাশি নওগাঁ মহকুমা প্রশাসক নিসারুল হামিদকেও গ্রেফতার করা হয় (ইনিও অবাঙালি ছিলেন)। ফলে নওগাঁ মহকুমা সদ্য ঘোষিত স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্ত এলাকায় পরিণত হয়।
এ সময় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ নওগাঁর প্রশাসনিক দায়িত্বভার গ্রহণ করে। দায়িত্ব গ্রহণকারী ব্যক্তিবৃন্দের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আওয়ামী লীগের মোহাম্মদ বায়তুল্লাহ (তিনি পরবর্তীতে বাংলাদেশের প্রথম ডেপুটি স্পিকার হন), আব্দুল জলিল, ন্যাপের (মোজাফফর) এম. এ. রকীব, ন্যাপের (ভাসানী) মোজাহারুল হক, এ.কে.এম. মোরশেদ এবং আরও কয়েকজন স্থানীয় নেতা।২৩ মার্চ নওগাঁয় স্বাধীনতা আন্দোলনের ওপর অধ্যাপক খন্দকার মকবুল হোসেন রচিত ‘রক্ত শপথ’ নামে একটি নাটক মঞ্চস্থ হয়। এ নাটকে স্বাধীনতা সংগ্রামের ভবিষ্যৎ রূপরেখা সম্পর্কে আভাস দেয়া হয়েছিল।
নাটকটি প্রযোজনা করেছিলেন মো: আব্দুল জলিল, নির্দেশনায় ছিলেন মমিন-উল-হক ভুটি। মঞ্চস্থ হয় নওগাঁ বি.এম.সি. কলেজ প্রাঙ্গনে। পরবর্তীকালে এ নাটকটি ভারতের বালুরঘাট, মালদহ ও শিলিগুড়ির বিভিন্ন স্থানে মঞ্চস্থ হয়। ভারতের মাটিতে এটি যৌথভাব মঞ্চস্থ করে বাংলাদেশের শরণার্থী শিল্পী-সাহিত্যিক গোষ্ঠী ও বাংলাদেশ শিল্পী-সাহিত্যিক সংঘ। ২৫ মার্চ কালো রাতে পাকবাহিনী রাজধানী ঢাকা সহ সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে গনহত্যা শুরু করে। ২৬ মার্চেই নওগাঁর সকল থানায় এ খবর পৌঁছে যায় এবং সেই দিনই নওগাঁ সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার শপথ নেয়।
পাকহানাদার বহিনীর নওগাঁ দখল
২১ এপ্রিল নাটোর থেকে অগ্রসরমান পাকহানাদার বাহিনী নওগাঁ অধিকার করার আগে সান্তাহার রেল জংশনের নাম পরিবর্তন করে ‘শহীদ নগর’ নামকরণ করে। এখানে ২৬ মার্চের পর বিহারি ও বাঙ্গালীদের মধ্যে সংঘঠিত সহিংস ঘটনায় বহু বিহারি প্রাণ হারায়। ২১ এপ্রিল দুপুর ১২টায় বিনা বাধায় হানাদার বহিনী নওগাঁয় প্রবেশ করে এর নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করে। ২২ এপ্রিল পাকবাহিনীর অপর একটি কনভয় ভারি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত অবস্থায় রাজশাহী থেকে সড়ক পথে নওগাঁয় প্রবেশ করে। তাদের নির্দেশমতো ঐ দিন রাতে পাকিস্তান রক্ষার লক্ষ্যে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। এ সময় নওগাঁর মুক্তিযোদ্ধারা সাময়িকভাবে পিছু হটে ভারতের সীমান্ত এলাকায় অবস্থান নেয়।
মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ নওগাঁ
২৪ এপ্রিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বালুরঘাট, বাঙালিপুর, টিয়রপাড়া ও মধুপুরে ক্যাম্প স্থাপন করে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের প্রস্তুতি চলতে থাকে। এ সমস্ত ক্যাম্পে দেড় মাস প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। পরবর্তীকালে মুক্তিযোদ্ধাদের উচ্চতর ট্রেনিংয়ের জন্য মালদা জেলার গৌড়বাগানে পাঠানো হত। উচ্চতর ট্রেনিং শেষ হবার পর মুক্তিযোদ্ধাদের শিলিগুড়ি ও পানিঘাটায় আর্মস ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানো হত। এখানে ৩ মাস অস্ত্রের কোর্স মাত্র ২১ দিনে শেষ করে মুক্তিযোদ্ধাদের পরে তরঙ্গপুর হেডকোয়ার্টার থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করে দেশের অভ্যন্তরে পাঠানো হত।
ইতিমধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধনায়ক জেনারেল ওসমানী সমগ্র বাংলাদেশকে ১১ টি সামরিক সেক্টরে বিভক্ত করেন। ৭নং সেক্টরের অধীনে ছিল নওগাঁ, নবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট, দিনাজপুর ও হিলি অঞ্চল। মেজর নূরুজ্জামান ছিলেন এ সেক্টরের অধিনায়ক। তার অধীনে ছিলেন মেজর নাজমুল হক, ক্যাপ্টেন গিয়াস সহ আরও অনেকে। মে মাসের প্রথমে মোকেলসুর রহমান রাজার নেতৃত্ব মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় দল নওগাঁয় প্রবেশ করে।
সম্মুখ সমরে মুক্তিবাহিনী১৯ মে এবং জুন মাসের প্রথম দিকে ধামইরহাট থানায় পৃথক পৃথক ২টি অপারেশন চালিয়ে মুক্তিবাহিনী ১জন পাক অফিসার সহ তাদের বেশ কয়েক জন সহযোগীকে হত্যা করে। এ অভিযানে ১জন মুক্তিযোদ্ধা নিহত এবং ২জন আহত হন। এ অভিযানে মুক্তিযোদ্ধারা ১টি জিপ সহ প্রচুর সামরিক সরঞ্জাম হস্তগত করেন।
১৩ জুন নওগাঁর মুক্তিযোদ্ধারা চকের ব্রীজ, আত্রাই থানার সাহাগোলা রেল ব্রীজ ও বগুড়া জেলার আদমদিঘী রেল ব্রীজ ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়। ফলে পাকহানাদার বাহিনীর রেল চলাচলে অনেক অসুবিধার সৃষ্টি হয়। এছাড়া পত্নীতলা থানায় ক্যাম্প স্থাপনের উদ্দেশ্যে যাত্রাকারী একদল পাকসৈনিকের উপর নওগাঁর মুক্তিযোদ্ধারা হামলা চলিয়ে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র অধিকার করে। এ হামলায় নেতৃত্ব দেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর নাজমুল।
প্রতিশোধপরায়ন পাকহানাদার বাহিনী এরপর নিরীহ মানুষের উপর নির্যাতন শুরু করলে স্বাধীনতা সংগ্রাম আরও বেগবান হয়। সাধারণ জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মুক্তি বাহিনীকে সহযোগীতা শুরু করে। তারা শত্রুপক্ষের সংবাদ ও অবস্থানের কথা গোপনে মুক্তি বাহিনীকে পৌঁছে দিত, গাইড হিসেবে পথ চিনিয়ে দিত। ১০ জুলাই পত্নীতলা উপজেলার মধইল নামক স্থানে মকাই চৌধুরীর নেতৃত্বে পাক বাহিনীর উপর হামলা চলিয়ে তাদের ৬ জনকে হত্যা করে।
১৬ জুলাই পাক বাহিনীর নদী পথে রাণীনগর থানার তিলাবুদু গ্রামে প্রবেশের সংবাদ পেয়ে ওহিদুর রহমান ও আলমগীর কবিরের নেতৃত্বে মুক্তি বাহিনী পাকহানাদার বাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়। এতে পাক বাহিনীর ২টি নৌকা ডুবে যায় এবং ৪জন পাকসৈনিকের মৃত্যু হয়। ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে মহাদেবপুর থানার হাপানিয়া মহাসড়কে মুক্তিবাহিনীর পেতে রাখা একটি শক্তিশালী বোমার আঘাতে ১টি জিপ ধ্বংস হলে ৫ হানাদার সৈন্য নিহত হয়।
এর প্রতিশোধ নিতে ১৫ আগস্ট পাক বাহিনী আশেপাশের গ্রামে নির্মম গণহত্যা চালায়। ১৯ সেপ্টেম্বর আত্রাই থানার বান্দাইখাড়া গ্রামে পাক বাহিনী ১৯টি নৌকাযোগে হামলা চালায়। এই সংবাদ পেয়ে ওহিদুর রহমান ও আলমগীর কবিরের নেতৃত্বে মুক্তি বাহিনী তারানগর ঘাউল্যা নামক স্থানে পাক বাহিনীর নৌকাতে হামলা চালায়। প্রচন্ড যুদ্ধে পাক বাহিনীর ৯টি নৌকাই ডুবে যায় এবং এই সাথে অসংখ্য রাজাকার ও পাকসেনার সলিল সমাধি হয়। ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর নওগাঁ হানদার মুক্ত হয়।
আরএম আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়
comment url